🎁 CREATE YOUR CUSTOMIZE GIFT BOX

৳ 0
0

Home

Account

WhatsApp

blog post 140525 The Sunnah Storehttps://www.thesunnahstore.co.uk/wp-content/uploads/2024/03/img-placeholder-jpg.webp" alt="image">
Mohaimin

May 14, 2025

Share

“আমি এমন মুসলিমদের সাথে খেতে বসেছি, ঘুমিয়েছি, যাদের গায়ের রঙ ছিল ধবধবে সাদা, চোখ ছিল নীল। কিন্তু তারা আমাকে ভাইয়ের মতো ভালোবেসেছে। হজ্জ আমাকে শিখিয়েছে—সত্যিকার ইসলাম রঙের ওপরে ভিত্তি করে না।”
— Letter from Mecca, 1964

একটি কক্ষে রাখা ছিল দুটি পুতুল—একটি ফর্সা, অন্যটি কালো। একইসাথে সেখানে উপস্থিত ছিল ৯-১০ বছর বয়সী কয়েকজন স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়ে। কিছুক্ষণ পর কক্ষে ঢুকলেন একজন ইন্টারভিউয়ার। তিনি প্রতিটি শিশুকে একটি সাধারণ প্রশ্ন করলেন: “তোমার মতে, এই দুটি পুতুলের মধ্যে কে ভালো আর কে খারাপ?”

প্রতিটি শিশু ডান পাশের পুতুলের দিকে আঙুল তুলল। কারণ জানতে চাইলে প্রায় সবাই একই কথা বলল—“কারণ ওটা দেখতে কালো।”
যুগের পর যুগ ধরে এই মানসিকতা, এই অন্যায় আচরণকেই বলা হয় রেসিজম—বা বর্ণবৈষম্য। এমন এক বৈষম্য, যেখানে একজন মানুষ আরেকজনকে মানুষ বলেই মনে করে না, শুধুমাত্র সে দেখতে তার মতো নয় বলে। তাকে দমন করা হয়, তার উপর জুলুম চালানো হয়—শুধু এজন্যেই যে তার স্কিন টোন ব্রাইট নয়।

না, আমি কোনো কল্পকাহিনি বলছি না। এগুলো বাস্তবতা।
চলুন, যাদের মুখে মানবাধিকারের বুলি শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি—তাদের ইতিহাসের এক ঘৃণ্য, অন্ধকার অধ্যায়ের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আসি।

 

দ্রোহের অঙ্কুর

 

সাল ১৫২৫। কোঁকড়া চুল, লম্বাটে গড়নের একজন আফ্রিকানকে শিকলবন্দি করে তুলে আনা হল। এই ধারাবাহিকতা চলমান থাকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত। বৃহত্তর আফ্রিকা মহাদেশের নানা উপকূল থেকে জাহাজে করে আনা হত শিকলবন্দি কৃষ্ণাঙ্গদের। চোখ ধাঁধানো আমেরিকান সভ্যতার নেপথ্যে ছিল চরম অবহেলিত কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রম। ১৭৭৫ সালেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশরা অন্যায্য কর ও লুটপাটে মত্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৮ বছরের যুদ্ধ শেষে আমেরিকা স্বাধীনতা অর্জন করে।

না, সে কৃতজ্ঞতা আমেরিকানরা কৃষ্ণাঙ্গদের দেখায়নি। ভিতরগত কলহ চলমান থাকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত। আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা দিলে এর পক্ষে-বিপক্ষে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। গৃহযুদ্ধে বিজয় লাভের পর, আব্রাহাম আনুষ্ঠানিকভাবে ১৮৬৫ সালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।

এটাই ছিল নেটিভ আমেরিকানদের (শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের) কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি চিরায়ত মানসিকতা। তারা চেয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গদের চিরকাল গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ রাখতে। সেই উদ্দেশ্যেই তারা গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে নৈরাজ্য পর্যন্ত সংগঠিত করেছে।

দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে—তবে আমেরিকা কি ফিরিঙ্গি আধিপত্য ও দমননীতির পথ থেকে সরে এসেছে? না, মোটেও না। জাতিগত নিধন আজও চলছে পুরোদমে। তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ইন্ডিয়ান কিলিং’। অথচ এই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ না বলে চালিয়ে দেওয়া হয় ‘লিঞ্চিং’—এই শব্দচাতুরীর আড়ালে।

লিংকনের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই, এক শতকের ব্যবধানে মার্কিন মাটিতে আবারও রক্ত ঝরল এক স্বপ্নবাজ মানুষের, যিনি চেয়েছিলেন ন্যায়ের ভোর আনতে—মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। পঞ্চাশের দশকে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তা ছিল একটি জাতিকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াই।

১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট, লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কিং বলেছিলেন—“আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম।”
মূলত এই ভাষণ ছিল আমেরিকার বিবেককে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা। তার কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন চাপ ছিল শাসকশ্রেণির ঘাড়ে। ফলও এসেছিল—১৯৬৪ সালে নাগরিক অধিকার আইন, ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন। কিন্তু ন্যায় কি কাগজে লিখলে সমাজেও নেমে আসে? উগ্র শ্বেতাঙ্গরা তা মেনে নেয়নি। আর ঠিক সেখানেই ইতিহাস ফের রক্তাক্ত—১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল, গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেন মার্টিন লুথার কিং।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজ এত বছর পর, সেই স্বপ্নের কতটা বাস্তবতা ধরা দিয়েছে মার্কিন সমাজে?

১৮৬৬ সালে গঠিত শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী এক গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন ‘কু ক্লাক্স ক্লান’ (KKK) আফ্রো-আমেরিকানদের ওপর নির্মম দমনপীড়ন চালাত। কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারকর্মী, কমিউনিস্ট ও সাধারণ নাগরিকদের টার্গেট করে তারা প্রকাশ্যে হত্যা করত। কখনও রাস্তায় তুলে নিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিত, কখনও আবার গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিত—তারপর উল্লাসে মিছিল করত।

আজও যুক্তরাষ্ট্রে গোপনে এই চক্রটির কার্যক্রম সচল রয়েছে। বিভিন্ন মিথ্যা প্রচার চালিয়ে তারা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা উসকে দিতে সচেষ্ট।

 

মহীরুহের অভ্যুদয়

 

কু ক্লাক্স ক্লান (KKK)-এর রক্তচক্ষু থেকে রক্ষা পায়নি আর্ল লিটল পরিবারও। আমেরিকার ওমাহা শহরে তারা অবস্থান করছিলেন। আর্ল লিটল ছিলেন একজন সাহসী কৃষ্ণাঙ্গ নেতা, যিনি মার্কাস গারভির আদর্শে বিশ্বাস করতেন। এই আদর্শের মূল কথা ছিল আত্মনির্ভরশীল কৃষ্ণাঙ্গ জাতি ও আফ্রিকায় প্রত্যাবর্তন। গারভির এই মতাদর্শ শ্বেতাঙ্গদের—বিশেষ করে KKK (Ku Klux Klan) ও Black Legion—এই দুই উগ্র শ্বেতাঙ্গ সংগঠনের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের পথে হুমকি স্বরূপ ছিল। এই দুই সংগঠন আর্ল লিটলকে একাধিকবার হত্যার হুমকি দেয়।

আর্ল লিটল ও তাঁর স্ত্রী লুইস লিটলের সাত সন্তানের পরিবারে ম্যালকম ছিলেন চতুর্থ সন্তান। ১৯২৯ সালে ম্যালকম তখন মাত্র চার বছরের শিশু। সেই সময় KKK তাদের ল্যানসিং, মিশিগান-এর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পরিবারটি বাধ্য হয় অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে। কিন্তু হুমকি থেমে থাকেনি।

১৯৩১ সালে এক রাতে আর্ল লিটলের মরদেহ রেললাইনের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়—মাথা থেঁতলানো ও শরীর রেলচাকা দ্বারা ছিন্নভিন্ন। সরকারিভাবে ঘটনাটিকে “দুর্ঘটনা” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যদিও ম্যালকম এক্স-সহ অনেকেই বিশ্বাস করেন, এটা ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড—Black Legion-এর কাজ।
এই ঘটনার পর ম্যালকমের মা লুইস লিটল চরম মানসিক চাপ, গ্লানি ও অর্থনৈতিক দুঃসহতায় ভেঙে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং ম্যালকমসহ তাঁর ভাইবোনেরা অনাথাশ্রম বা পালক পরিবারের আশ্রয়ে চলে যায়। শৈশব থেকেই ম্যালকম প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে এক বর্ণবাদী সমাজ শুধু একজন মানুষকে নয়—একটি পরিবার, একটি সম্পূর্ণ পরিচয় ও স্বপ্নকে নির্মমভাবে ধ্বংস করে দেয়।

১৯৪৬ সালে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করে ম্যালকমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই গ্রেফতারির পেছনেও অনেক ক্রিস্টাল ক্লিয়ার প্রশ্ন তোলা যায়। কারণ ম্যালকমের বাবা ছিলেন বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যের নেতা। এছাড়াও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি প্রশাসনের নজর ছিল বরাবরই বৈষম্যমূলক।
সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৯ সালে পুলিশের গুলিতে ১,০১৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, যাদের মধ্যে অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান।
এছাড়াও ১৭৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে যুক্ত হয় দ্বিতীয় সংশোধনী, যেখানে বলা হয়—“নাগরিকদের অস্ত্র রাখার ও বহনের অধিকার থাকবে, এবং সে অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে না।” এই বিধান মূলত প্রণীত হয়েছিল, যেন সাবেক ঔপনিবেশিক শাসনের পর শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে এবং নতুন গঠিত সমাজ কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করা যায়। নিরাপত্তা কাদের থেকে?  জি, ঠিকই ধরেছেন—কৃষ্ণাঙ্গদের থেকে।

 

পাঠশালায় দিন বদল

কারাগারের দিনগুলো নিয়ে ম্যালকম একবার বলেছিলেন,

“People don’t realize how a man’s whole life can be changed by one book.”

কারাগারে শুরুর দিনগুলোতে মালকম এক্স ছিলেন বদমেজাজি ও হতাশাগ্রস্ত। তিনি নিজেকে ভাবতেন এক অবহেলিত, নিগ্রো যুবক, যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই আমেরিকাতে। তখনো তিনি ছিলেন গালাগালি ও প্রতিবাদী মনোভাবের একজন, যার জীবন মানে ছিল কেবল প্রতিশোধ।

ঠিক তখন উত্তম সঙ্গী হয়ে মালকমের জীবনে আসে ব্রাদার বুকার টি। বুকার ছিলেন Nation of Islam-এর সদস্য। নেশন অফ ইসলাম ইসলামের মূল ধারার চিন্তাচেতনা লালন করত সেটা বলা যায় না। কিন্তু নেশন অফ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা এলিজা মুহাম্মদের লেখা চিঠি তাঁর হৃদয়ে আলো জ্বালায়। তিনি নিজেকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করেন। ইসলামী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নিজের অতীতের ভুল ও পথভ্রষ্টতা উপলব্ধি করেন। এ সময় থেকেই মালকম ধীরে ধীরে চিন্তা ও আত্মপরিচয়ের গভীরে প্রবেশ করেন।

জেলে থাকা অবস্থায় ম্যালকমের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হয়ে উঠে লাইব্রেরি। অক্ষর না চিনার কারণে তিনি একে একে সকল অভিধান পড়ে নিজের শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করতে থাকেন। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম—সব ধরনের বই পড়তে শুরু করেন। বইয়ের প্রতি এই ভালোবাসা তাঁর জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নেশন অফ ইসলামের আদর্শ ছিল কট্টর কৃষ্ণাঙ্গবাদী। যা ছিল কট্টর কট্টর শ্বেতাঙ্গবাদিদের মতই। অর্থাৎ জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব। ম্যালকমের সাথে নেশন অফ ইসলামেরও বেশ ভালো রকমের মতপার্থক্য তৈরি হয়। বিশেষ করে সংগঠনের নেতা এলিজা মুহাম্মদের সাথে।

এর মূল কারণ কি ছিল? যে সংগঠন তাঁকে নতুন জীবন দান করেছে, জীবনে কিছুটা ডিসিপ্লিন এনে দিয়েছিল, তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ হওয়া অভিশাপ এই চিন্তা থেকে বের করে এনে ব্ল্যাক সুপ্রেমিসি মেন্টালিটি মনভাব গঠনে সহযোগিতা করেছিল, সে সংগঠনের সাথে কেন হয়েছিল এতটা দূরত্ব?

প্রশ্নটা সহজ, উত্তরটাও। ম্যালকম কখনও দলের অন্ধ অনুকরণ করেনি। তিনি জানতে পারেন যে, নেশন অফ ইসলামের নেতা এলিজা মুহাম্মদ গোপনে তাঁর একাধিক মহিলা সচিবের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। মালকম এক্স, যাকে আল্লাহর প্রেরিত নেতা হিসেবে মানতেন, তার এ ধরনের আচরণে তিনি গভীরভাবে হতাশ ও ব্যথিত হন।

এছাড়াও, ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডির হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মালকম এক্স বলেন, “এটা হলো মুরগি নিজের ঘরে ফিরে এসেছে,” অর্থাৎ আমেরিকার সহিংসতার ফলাফল হিসেবে তিনি ঘটনাটিকে দেখেন। এই মন্তব্যের কারণে নেশন অফ ইসলাম তাঁকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করে। এই ঘটনা নেতৃত্বের সঙ্গে তার দূরত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে।

এবং যেমনটা আমরা আগেই বলেছিলাম, নেশন অফ ইসলাম ছিল উগ্র কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তায় বিশ্বাসী। নেশন অফ ইসলাম কেবল কালোদের আত্মনির্ভরতা ও নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিত। এই মতাদর্শ মালকমের চিন্তায় দাগ ফেলে। কারণ, এইখানে এসেও তিনি বৈষম্য ছাড়া ভিন্ন কিছু দেখলেন না। নেশন অফ ইসলামের “সকল শ্বেতাঙ্গই শয়তান” — এই মতবাদ নিয়ে মালকম এক্স পরবর্তীতে প্রশ্ন তোলেন।

 

মোড়

 

একজন মানুষ এমন ইতিহাসের এমন সময় বড় হয়েছেন, যখন রেসিজমের উর্বর সময় যাচ্ছিল। প্রতিনিয়ত তাঁকে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছিল। এছাড়াও সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোগত বিদ্বেষ, দিচারিতা তো আছেই। এরপর যে সংগঠন তাঁকে নতুন লাইফস্টাইল দিয়েছে, সেখান থেকেও তিনি তেমন সন্তুষ্টি পেলেন না—এ যেন মুদ্রার এই পিঠ আর ওই পিঠ। অর্থাৎ ম্যালকমের জীবনের উৎকর্ষের একমাত্র বিষয় ছিল বর্ণ বা বর্ণকেন্দ্রিক বৈষম্য। যার সমাধান তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, হয়েছে নৈরাজ্য, বেড়েছে বিশৃঙ্খলা।
জেল থেকে বের হওয়ার পর তিনি নেশন অফ ইসলামের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। কিন্তু আমরা আগেই জেনেছি, এই সক্রিয়তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। নেশন অফ ইসলাম ম্যালকমকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে ঠিকই, কিন্তু এই সংগঠন ইসলামের মৌলিক মতাদর্শ থেকে ছিল যোজন যোজন দূরে। নেশন অফ ইসলাম থেকে সদ্য বিচ্ছিন্ন, তিনি খুঁজছিলেন সত্যিকার ইসলামের বার্তা। ১৯৬৪ সালে ম্যালকম গঠন করেন Muslim Mosque, Inc.। ওই বছরের এপ্রিলে তিনি রওনা হন হজ্জের উদ্দেশ্যে।

 

বায়তুল্লাহর ছায়ায়

 

জেদ্দার ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে আছে ম্যালকম। আরব পুলিশ বেশ ভালই জেরা করছে। সমস্যা হচ্ছিল তাঁর পরিচয় শনাক্ত নিয়ে। অফিসার তাঁর মুসলিম পরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। ভাষা জানেন না, কাগজপত্রে জাতীয়তা বিভ্রান্তিকর—অচেনা দেশে তিনি যেন একা, অথচ প্রত্যয়ী।

আল্লাহর কুদরতে, কিছুক্ষণের মধ্যে এক সৌদি অধ্যাপক এগিয়ে এলেন। ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন এমন কেউ একজন—এই পরিচয়েই তিনি ম্যালকমের পাশে দাঁড়ালেন। বিষয়টি গড়ায় উচ্চ পর্যায়ে। সৌদি রাজপরিবারের সদস্যরা খোঁজ নেন। সত্যতা যাচাইয়ের পর তাঁকে ভিআইপি মর্যাদায় মক্কায় পাঠানো হয়।

ম্যালকম এখন মক্কায়। ইহরাম পরে, চোখে জল নিয়ে তাওয়াফ করছেন। কালো পাথর ছুঁয়ে চোখ বুঁজে আছেন বহুক্ষণের জন্য। পাশে দাঁড়িয়ে একজন ফরাসি মুসলিম, অন্য পাশে একজন তুর্কি হাজি, আরেক পাশে একজন আফ্রিকান রাজপুত্র—কিন্তু কারও মধ্যে বিভেদ নেই। এক কাতার, এক জামা, এক উদ্দেশ্য। এই পরিস্থিতি ব্যক্ত করতে গিয়ে ম্যালকম বলেনঃ

“আমি সাদা চামড়ার মুসলমানের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়েছি, একই খাবার ভাগ করে খেয়েছি। আমি কখনও ভাবিনি, সাদা মানুষ এভাবে আমার ভাই হতে পারে। ইসলাম আমার হৃদয়ের বিভ্রান্তি দূর করেছে।”
আরাফাতে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তিনি অনুভব করেন, এ যেন কিয়ামতের ময়দান—সব জাতি, সব ভাষা, সব পেশার মানুষ শুধু এক পরিচয়ে একত্রিত: মুসলমান। সে রাতেই তিনি চিঠি লেখেন বন্ধুদের কাছে। তাঁর কলমে যেন আগুন আর অশ্রুর মিশেল—

“If white Americans could accept the Oneness of God… perhaps they too could accept the Oneness of Man…”

মজার ব্যাপার হলো, এই আরাফাতের ময়দানেই আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১০ হিজরির এই ভাষণে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন কিছু কথা বলেন, যা আজও বর্ণ বৈষম্যের শিকার মানুষদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। বিদায় খুতবায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

“সমস্ত মানবজাতি আদম ও হাওয়া থেকে এসেছে। একজন আরবের আরেকজন অনারবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন অনারবেরও একজন আরবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আবার কৃষ্ণদের উপরেও শ্বেতাঙ্গদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আবার শ্বেতাঙ্গদের উপর কৃষ্ণদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই—শুধু মাত্র নেক আমল এবং পরহেজগারিতা ছাড়া।”

এটাই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। ইসলামে কে বড় মাপের মানুষ, কার সম্মান বেশি—সেটা নির্ধারিত হবে শুধু একটি মাত্র মানদণ্ডে, আর তা হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

“হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারীর মধ্য থেকে, এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন, যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।” [সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩]

ম্যালকম ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, সে কী দীন গ্রহণ করেছে। পদে পদে লাঞ্ছিত হওয়া, জেল-জুলুমের শিকার, নিজের বাবার হত্যা, সে শোকে নিজ মায়ের মানসিক সমস্যা—অর্থাৎ নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষ যখন দেখে, এক কাতারে সবাই দাঁড়িয়ে তাদের এক রবের ইবাদত করছে, এক জায়গায় খাচ্ছে, তাকে ভাই বলে সম্বোধন করছে, তার জন্য উত্তম কিছু ছেড়ে দিচ্ছে—মিনা ও আরাফার ময়দানে; জমজমের পানি এক পাত্রে দুই দেশের মানুষ পান করছে, অথচ তাদের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই; সাফা-মারওয়ায় একসাথে তাওয়াফ করছে এবং ক্লান্তির সময় তাকেই শ্বেতাঙ্গ কোনো মানুষই পানি এগিয়ে দিচ্ছে; কুরবানির দিনে একে অপরকে সহযোগিতা করছে—তখন তাঁর অন্তরের ভিতরের অবস্থা চিন্তা করুন!

 

মক্কা থেকে প্রেরিত পত্র (২০ এপ্রিল, ১৯৬৪)

 

“আমি মক্কার পবিত্র নগরীতে আসার সৌভাগ্য লাভ করেছি। আমি কাবা শরীফের চারপাশে সাতবার তাওয়াফ করেছি, যেখানে আমাকে একজন তরুণ মুতাওয়াফ, মুহাম্মদ, নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমি জমজম কূপের পানি পান করেছি। আমি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌড়েছি। আমি মিনার প্রাচীন নগরীতে নামাজ আদায় করেছি এবং আরাফাত পর্বতে নামাজ পড়েছি।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার হাজী এখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ সোনালি চুল ও নীল চোখের শ্বেতাঙ্গ, আবার কেউ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান। তবে আমরা সবাই একই আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি, এমন একতা ও ভ্রাতৃত্বের চেতনা প্রদর্শন করেছি যা আমার আমেরিকায় অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কখনোই সম্ভব বলে মনে হয়নি শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যে।

আমেরিকার উচিত ইসলামকে বোঝা, কারণ এটি এমন একটি ধর্ম যা সমাজ থেকে বর্ণবাদের সমস্যা মুছে দেয়।
মুসলিম বিশ্বে আমার ভ্রমণের সময়, আমি এমন অনেক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি, কথা বলেছি এবং একসাথে খেয়েছি, যাদের আমেরিকায় ‘শ্বেতাঙ্গ’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো—কিন্তু ইসলামের কারণে তাদের মন থেকে ‘শ্বেতাঙ্গ’ মনোভাব মুছে গেছে। আমি আগে কখনো এমন আন্তরিক ও সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ব দেখিনি, যেখানে সব বর্ণের মানুষ একসাথে, তাদের রঙ নির্বিশেষে, এই ভ্রাতৃত্ব অনুশীলন করছে।”

এই হজ্জযাত্রা ম্যাল্কঙ্কে এতটাই পরিবর্তন করে যে তিনি তাঁর নিজের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন,  আল-হাজ্জ মালিক আল-শাব্বাজ। নামের সাথে তিনিও পরিবর্তন আনে তাঁর মিশন এবং ভিশনে। হজের মত একটি ফরজ ইবাদত কিভাবে একজন মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে, ম্যালকম এর উৎকৃষ্ট উদাহরন।

 

একজন মুসলিমের জাতিয়তা

 

আমাদের জাতীয়তা কোনো ভূখণ্ডের সীমারেখায় আটকে নেই, কোনো জাতি কিংবা রাষ্ট্রের নামের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বাঁধা নয়। আমরা মুসলিম—আমাদের জাতীয় পরিচয় হচ্ছে ঈমান। কোনো সীমান্ত, কোনো বর্ণভেদ আমাদের ভ্রাতৃত্বকে বিভক্ত করতে পারে না। ঈমানই আমাদের বন্ধন, আর সেই ঈমানই আমাদের এনে দেয় এক মহিমান্বিত পরিচয়—দারুল ইসলামের গর্বিত একজন সদস্য হওয়ার সম্মান

আমাদের আত্মিক আত্মীয়তা কেবল তাদের সঙ্গেই, যারা একই কালেমায় বিশ্বাসী। এটাই সেই উম্মাহ, যার প্রথম কাতারে ছিলেন—আরবের আবু বকর, আবিসিনিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ বিলাল, রোমের সুহাইব, পারস্যের সালমান আল ফারসি, আর হাবশার আম্মার ইবনে ইয়াসির। এই দীন তো সেই দীন যা কৃষ্ণাঙ্গ অবহেলিত বিলাল কে দিয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ, যার পদধ্বনি রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতে শুনতে পেয়েছেন মিরাজে গিয়ে, রদিয়াল্লাহু আযমাঈন। ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ডের, জাতি ও গোত্রের হওয়া সত্তেও তারা কেউই নিজেদের গোত্র, জাতি বা ভূখণ্ডের পতাকা হাতে হাজির হননি; বরং তাঁদের হাতে ছিল এক পতাকা—ঈমানের পতাকা

এই উম্মাহর পরবর্তী প্রজন্মও এই একই বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। তাদের পরিচয় ছিল মুসলিম, জাতীয়তা ছিল ঈমান, জন্মভূমি ছিল দারুল ইসলাম, শাসক ছিলেন আল্লাহ তাআলা, আর সংবিধান ছিল কুরআন।
এটাই তো আমাদের পরিচয়—সবকিছুর ঊর্ধ্বে এক ও অভিন্ন উম্মাহ।

 

Related Posts